ইতিহাসফিচারভ্রমণ

এগারো শিব মন্দির : রাজা নীলকণ্ঠ রায়ের স্মৃতি বিজড়িত মন্দির!

এগারো শিব মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রাজা নীলকণ্ঠ রায়। তিনি ছিলেন চাঁচড়া রাজবংশের নবম পুরুষ। চাঁচড়া জমিদারীর প্রতিষ্ঠাতা রাজা মনোহর রায় ছিলেন নীলকন্ঠ রায়ের পরদাদা। নীলকণ্ঠ রায়ের মেয়ের নাম অভয়া। রাজা নীলকন্ঠ যশোরের এই নগরীটি মেয়েকে দিয়ে দেন অল্পবয়সে বিধবা হবার পর। আর এই নগরীর নাম নিজের মেয়ের নামে রাখেন অভয়নগর। কারো কারো মতে, সে সময়ে হিন্দু ধর্মে দ্বিতীয় বিবাহের কোনো নিয়ম না থাকায় অভয়া বাকি জীবন পূজা-অর্চনা করে কাটাতে চায়। নীলকণ্ঠ মেয়ের অনুরোধে ১৭৪৫ সাল থেকে ১৭৬৪ সালের মধ্যে ১১টি শিব মন্দির স্থাপন করেন। সেটিই এগারো শিব মন্দির নামে পরিচিত।

এগারো শিব মন্দির এর ইতিহাস

যশোহর খুলনার ইতিহাস নামের বইটি পড়ে আমি জানতে পারি, রাজা নীলকণ্ঠের সময়ে ভাস্কর পন্ডিত নামের একজন দুর্দান্ত সেনাপ্রধানের নেতৃত্বে মারাঠারা বর্ধমান আক্রমণ করে। এই আক্রমণই বর্গীয় হাঙ্গামা নামে পরিচিত। বর্গীর উৎপাতে পুরো পশ্চিম বঙ্গের নাজেহাল অবস্থা। ফলে পশ্চিমবঙ্গের রাজস্যবর্গ পূর্বে এসে আশ্রয় খুঁজতে শুরু করে। একই সময় রাজা নীলকন্ঠও এদের জন্য আশ্রয় খুঁজছিলেন।

#আরও পড়ুন: ষাটগম্বুজ মসজিদ: ঐতিহ্য ও ইতিহাসের বাহক!

রাজা তার দেওয়ান হরিরাম মিত্রকে ভৈরব নদীর তীরে পরিখাবেষ্টিত রাজবাড়ি বানাতে বলেন। হরিরামেরও কোনো পাকা বাড়ি ছিলো না। রাজা নিজ থেকেই হরিরামের জন্যও একটা বাড়ি বানাতে বলেন। হরিরামের বাড়ি ছিলো বাঘুটিয়ায়। তাই বাঘুটিয়ার কাছে অভয়নগরে হরিরামের নিজের বাড়ি এবং এখান থেকে খানিক দূরের ধূলগ্রামে রাজবাড়ি নির্মিত হলো।

তখনকার সময়ে দেবমন্দিরই ছিলো রাজবাড়ির প্রধান সৌন্দর্য এবং মন্দিরের দেব-দেবীর বিগ্রহই ছিলো প্রধান সম্পদ। তাই রাজবাড়ির সৌন্দর্য বৃদ্ধি করার জন্য ধূলগ্রামের রাজবাড়ির কাছে ভৈরব নদীরতীরে বারোটি মন্দির তৈরি করা হয়। এবং অভয়নগরে নদী থেকে একটু দূরে তৈরি হয় এগারোটি শিব মন্দির। অভয়নগরের বাড়িটি দেওয়ানের বাড়ি বলে মন্দিরের সংখ্যা একটি কম।

ধূলগ্রামের বাড়িটি পাকা ও দৃঢ প্রাচীরে বেষ্টিত ছিল। কিন্তু অভয়নগরের বাড়িটির গাঁথুনি ছিলো কাঁচা, এবং প্রাচীর তেমন দৃঢ় ছিল না। দুটি বাড়িই পরিখাবেষ্টিত; একপাশে ভৈরব নদ আর বাকি তিন পাশে গড়খাই। বাড়ি নির্মাণের শেষ দিকে পরিদর্শন করতে এসে রাজা নীলকন্ঠ বললেন, রাজাদের অস্থায়ী নিবাস খুব দৃঢ় হওয়ার প্রয়োজন নেই।

হরিরাম স্থায়ীভাবে ধূলগ্রামের বাড়িতে থাকতে পারে। রাজাদের জন্য অভয়নগরের বাড়িই যথেষ্ট। এইজন্যই হয়তো অভয়নগরের রাজবাড়ির অস্তিত্ব এখন আর নেই৷ সেখানে এখন পানের বরজ করা হয়েছে।

এগারো শিব মন্দির এর খোঁজে

ভৈরব নদ পেরিয়েই আমাদের রাজা নীলকণ্ঠের এগারো শিব মন্দির যেতে হবে। তারজন্য আগে যেতে হবে ভাটপাড়া ঘাটে৷ ভাটপাড়া ঘাটে গিয়ে দেখি এতো বড় আকৃতির নৌকা ভৈরবের তীরে শুয়ে আছে আমাদের পারাপারের জন্য। এটি আকারে এতোই বড় যে এতে করে মালবাহী গাড়িও পার হতে পারে।

#আরও পড়ুন: চাঁচড়া শিব মন্দির : রাজা মনোহর রায়ের জমিদারির প্রতীক!

ভৈরব পেরিয়ে আমরা ভ্যানে চড়লাম এগারো শিব মন্দির যাবার জন্য। মন্দিরে যাওয়ার পথটা এতো মায়াময়! গ্রাম্য রাস্তা, কিন্তু পিচঢালা। আমাদের ভ্যান মসৃণগতিতে নিয়ে যাচ্ছে গন্তব্যে। দুইপাশে গাঢ় সবুজে ছেয়ে থাকা গ্রাম।

একধারে প্রাচীন বাড়ির ধ্বংসস্তূপ দেখতে পেলাম। এটিই সেই রাজবাড়ি কী না, কে জানে! ভ্যান মন্দির গুচ্ছের প্রবেশদ্বারের কাছে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলো। আশেপাশে আর কোনো মানুষের সাড়াশব্দ নেই। কোনো বাড়িঘরও দেখা যাচ্ছে না।

এগারো শিব মন্দির এর বর্ণনা

এগারো শিব মন্দিরের দক্ষিণ দিকে প্রবেশপথের দু’দিকে রয়েছে দুটি মন্দির। দুইপাশে দুটি অপ্রধান মন্দির রেখে মন্দির প্রাঙ্গনে প্রবেশ করলাম। আমার কাছে মনে হলো, যেনো অন্য এক জগতে প্রবেশ করেছি। কেমন গা ছমছমে অনুভূতি। মনে হচ্ছিলো দেড়শো বছর আগের প্রাচীন জগতে অনুপ্রবেশ ঘটেছে আমার।

ঠিক সামনেই মূল মন্দিরটি নিজের সমস্ত দর্প নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে। পশ্চিম দিকে। পূর্ব ও পশ্চিম সারিতে চারটি করে মোট আটটি মন্দির। সব মিলিয়ে এগারোটি মন্দির। প্রত্যেকটি মন্দির মাঝখানের উঠোনের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। প্রধান মন্দিরটিকে সংস্কার করায় তার পূর্বের দম্ভ ফিরে এলেও, বাকি মন্দিরগুলোর অবস্থা সঙ্গীন।

#আরও পড়ুন: প্রথম আলো: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের এক অমর সৃষ্টি!

মূল মন্দিরটির দৈর্ঘ্য ২৪ ফুট ৪ ইঞ্চি আর প্রস্থ ২২ ফুট ৩ ইঞ্চি। দেয়ালের প্রস্থ ৩ ফুট ৪ ইঞ্চি। মন্দির নির্মাণে ব্রিটিশ আমলে অনুসৃত চুন সুরকি এবং ইটের ব্যবহার করা হয়েছে। ইটের আকৃতি পাতলা ও বর্গাকার। চুন-সুরকির প্রলেপ ধরে রেখেছে ইটগুলোকে।

প্রত্যেকটি মন্দিরে আগে একটি করে মোট বারোটি শিবলিঙ্গ ছিলো, এদের প্রত্যেকের নামে ১২০০ বিঘা জমি নিষ্কর দেওয়া হয়েছিলো। প্রতিদিন দেবসেবায় যেসব ভোজ্য দেওয়া হতো, পূজা সম্পন্ন হবার পর তা গ্রামের ব্রাহ্মণ পরিবারগুলোতে ভাগ বাটোয়ারা করে পাঠানো হতো। তা দিয়ে ৩০টি ব্রাহ্মণ পরিবারের সংসার চলত।

বারোটি শিবলিঙ্গের মধ্যে এখন শুধুমাত্র মূল মন্দিরেই একটি শিবলিঙ্গের অবশিষ্ট কিছু ভগ্নাংশ আছে। বড় মন্দিরে এখনো নিয়মিত পূজা হয়। পূজারীর দেখা না পেলেও প্রমাণ পেলাম আমরা। বড় মন্দিরের দেয়ালে কিছু ইট পাথর ঝোলানো দেখলাম। দেখেই মনে হলো কোনো ধরণের মানতের চিহ্ন এগুলো।

দিবাকর দাদার কাছে ছবি দেখিয়ে এর মানে উদ্ধার করলাম। তিনি যা বললেন, তা সরাসরি তুলে দিচ্ছি।

‘পাপভার ঈশ্বরে সমর্পণ। ইট অথবা পাথরগুলো কর্মের প্রতীক। সেই কর্ম হতে মানুষকে উদ্ধার করেন মহাকাল। এটা সাধারণ মানত নয়। মুক্তির মানত।’

প্রতিটি মন্দিরে প্রবেশের জন্য আছে খিলানাকৃতির প্রবেশপথ ও উপপ্রবেশপথ, বাকানো ও কোণাকৃতির কার্ণিস। রয়েছে অনিন্দ্যসুন্দর কারুকার্য। তার মধ্যে রয়েছে পদ্মসহ আরো অনেক চিত্রের মোটিফ। মন্দিরের বিশেষত্ব হলো এটি স্থানীয় রীতিতে নির্মিত। সে সময়ে যে বাংলায় উন্নত মানের স্থাপত্যকলা ছিলো এই মন্দিরটিই তার প্রমাণ।

ছাদগুলো নির্মিত হয়েছে উলম্ব ধরনের ডোমের সমন্বয়ে। অর্থাৎ দুই স্তরে নির্মিত ছাদের ভেতরে গোলাকার এবং বাইরে চার চালা রীতিতে নির্মিত। সবগুলো মন্দির নির্মাণে স্থানীয় উপকরণ, নির্মাণশৈলি এবং দক্ষতার ছাপ পাওয়া যায়।

মন্দিরের চারপাশে একসময় প্রাচীর বেষ্টিত ছিল। এখনও তার চিহ্ন রয়েছে। সেই সময়কার প্রচুর ইটও পড়ে ছিল সেখানে। সেসব ইট গ্রামবাসী কিনে নিয়ে নিজেদের বাড়ি নির্মাণের কাজে ব্যবহার করেছে। মন্দিরের উত্তর-পশ্চিম কোণে একটি পুকুর ছিলো।

এগারো শিব মন্দির

মন্দিরগুলো জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে ছিলো অনেকগুলো বছর। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর প্রথম ধাপের সংস্কার কাজ শুরু করে, যা শেষ হয় ২০১৭ সালে। ফলে দৃষ্টিনন্দন এই স্থাপনাগুলো ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে।

মন্দিরে অনেকক্ষণ ছিলাম আমরা। মানুষজন না থাকায় খুব উপভোগ করছিলাম প্রাচীনত্ব। হঠাৎ হঠাৎ মনে হচ্ছিল এই বুঝি প্রাচীন ডামাডোল বেজে উঠলো। শ’খানেক মানুষ নিয়ে প্রাচীন সময়কার সেই মন্দির পূজার জন্য প্রস্তুত। লোকের পদচারণে গমাগম করে উঠবে সব। কিন্তু না। প্রাচীন সেই নীরবতা ভেঙে দিয়ে কিছু দর্শক কিংবা ভ্রমণকারী এলো৷ তাদের দেখে মনে হলো, কোনো শর্টফিল্ম কিংবা গানের ভিডিও বানাতে এসেছে। আমরাও তাই আর বেশিক্ষণ থাকলাম না। প্রাচীন জগত ছেড়ে পা বাড়ালাম আধুনিকতায়।

ভাটপাড়া ঘাটে নৌকা আসতে দেরি হচ্ছিল। তাই আমরা ঘাটের পাশেই মিষ্টির দোকানে ঢুকলাম। দত্তের দই মিষ্টির দোকান। এক হাড়ি দই কিনলাম ৪০ টাকা দিয়ে।

কীভাবে যাবেন

ঢাকা থেকে সড়ক, রেল ও আকাশপথে যশোর (Jessore) যাওয়া যায়। ঢাকার গাবতলী, কল্যাণপুর, কলাবাগান থেকে গ্রিন লাইন পরিবহন, সোহাগ পরিবহন, ঈগল পরিবহন, শ্যামলী পরিবহনের এসি বাস যশোর যায়। ভাড়া ৮শ’ থেকে ১ হাজার টাকা। এ ছাড়া হানিফ, শ্যামলী, সোহাগ, ঈগল ইত্যাদি পরিবহনের নন-এসি বাসও যশোর যায়। ভাড়া ৩৫০ থেকে ৪৫০ টাকা।

এগারো শিব মন্দির

ঢাকার কমলাপুর থেকে সপ্তাহের শনিবার ছাড়া প্রতিদিন সকাল ৬টা ২০ মিনিটে আন্তঃনগর ট্রেন সুন্দরবন এক্সপ্রেস এবং সোমবার ছাড়া প্রতিদিন সন্ধ্যা ৭টায় আন্তঃনগর ট্রেন চিত্রা এক্সপ্রেস যশোরের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। ভাড়া শোভন ৩৫০ টাকা, শোভন চেয়ার ৪২০ টাকা। প্রথম শ্রেণি চেয়ার ৫৬০ টাকা। প্রথম শ্রেণি বার্থ ৮৪০ টাকা। স্নিগ্ধা শ্রেণি (এসি চেয়ার) ৭০০ টাকা। এসি বার্থ ১,২৬০ টাকা। ঢাকা থেকে ইউনাইটেড এয়ারলাইন্স, রিজেন্ট এয়ারলাইন্স ও নভো এয়ারের বিমান নিয়মিত যশোরের পথে চলাচল করে।

কোথায় থাকবেন

থাকার জন্য যশোর শহরকেই বেছে নিতে হবে। সেখানে থাকা এবং খাবারের জন্য হোটেল পেয়ে যাবেন। ভালো আবাসিক হোটেলের মধ্যে হোটেল আমিন এবং হোটেল মিডটাউন উল্লেখযোগ্য।

ইতিহাস অংশের তথ্যসূত্র: যশোহর খুলনার ইতিহাস by সতীশচন্দ্র মিত্র

প্রকৃতি সৃষ্টিকর্তার অপূর্ব উপহার। সেই সাথে আমাদের সম্পদ। আমাদের টুরিস্ট স্পটগুলো পরিষ্কার রাখার দায়িত্ব আমাদের নিজেদের। পাহাড়ে গেলে অপচনশীল আবর্জনা যেখানে সেখানে ফেলে এসে প্রকৃতিস্থ সৌন্দর্য নষ্ট করবেন না।

আসুন, ঘোরাঘুরির সাথে সাথে দর্শনীয় স্থানগুলো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রেখে সুরুচির পরিচয় দিই। কারণ, মন সুন্দর যার, সেই তো দেশ পরিষ্কার রাখে।

Back to top button

Opps, You are using ads blocker!

প্রিয় পাঠক, আপনি অ্যাড ব্লকার ব্যবহার করছেন, যার ফলে আমরা রেভেনিউ হারাচ্ছি, দয়া করে অ্যাড ব্লকারটি বন্ধ করুন।