নীরা আর্য: এক অকুতোভয় সংগ্রামী নারী!
নীরা আর্য, যার নামের সাথেই মিশে রয়েছে এক ভয় না পাওয়া নারীর গল্প। তিনি আপোষহীন, দুঃসাহসী, আকুতোভয় এক সংগ্রামী নারী। তাঁর জীবন কাহিনী শুনলে যে কেউই অবাক হবেন। ভারতের স্বাধীনতায় এক সক্রিয় নীরব যোদ্ধা নীরা আর্য। তবে ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসের এই মহান নারীকে ক’জনই বা চেনেন। লোকচক্ষুর অন্তরালে কষ্টে জীবন কাটিয়েছেন এই মহিয়সী নারী। নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুকে রক্ষা করার জন্য তাঁর সাহসিকতা অমর হয়ে লেখা থাকবে। তাঁর নাম লেখা থাকবে আজাদ হিন্দ ফৌজের সঙ্গে। দুঃসাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন তিনি তাঁর কাজে। নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুকে রক্ষা করার জন্য তিনি তাঁর স্বামীকে হ’ত্যা করতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি। তাঁর এই সাহসিকতার জন্য ইতিহাসে এই মহিয়সী নারী অমর হয়ে রয়েছেন।
নীরা আর্য এর জন্ম ও পরিচয়:
নীরা আর্য ভারতের তৎকালীন ইউনাইটেড প্রদেশের অধুনা উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের বাগপত জেলার খেকড়া শহরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৯০২ সালের ৫ মার্চ। তাঁর পিতা শেঠ ছজুমল সে সময়ের এক বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ছিলেন। তাঁর পিতার ব্যবসায়ের মূল কেন্দ্র ছিল কলকাতা। তবে শেঠ ছজুমলের ব্যবসা-বাণিজ্য সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। তাই নীরার পড়াশোনা শুরু হয়েছিল কলকাতাতেই। তাঁর বাবা তাকে আর তাঁর ভাইকে নিয়ে কলকাতাতেই থাকতেন। নীরা আর্য হিন্দি, ইংরেজি, বাংলার পাশাপাশি আরও অনেক ভাষায় দক্ষ ছিলেন। তাঁর ভাইয়ের নাম বসন্ত কুমার, তিনিও ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। তিনি আজাদ হিন্দ ফৌজে ছিলেন।
নীরা আর্য ছিলেন দেশপ্রেমিক, সাহসী ও প্রবল আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন একজন নারী। সিআইডি ইন্সপেক্টর শ্রীকান্ত জয়রঞ্জন দাসের সঙ্গে নীরা আর্য বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ইংরেজপ্রভু ভক্ত অফিসার ছিলেন শ্রীকান্ত জয়রঞ্জন দাস। শ্রীকান্ত জয়রঞ্জন দাসকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুকে হত্যা করার জন্য। তিনি নেতাজিকে হত্যার জন্য চেষ্টা করেছিলেন।
আরও পড়ুন# হুমায়ূন আহমেদ : বাংলা সাহিত্যের রাজপুত্র
নীরা আর্য এর আজাদ হিন্দ ফৌজে যোগদান ও তাঁর কার্যক্রম:
নীরা আর্য পড়াশুনো সম্পন্ন করে যোগ দেন আজাদ হিন্দ ফৌজের রানি ঝাঁসি রেজিমেন্টে। তখনকার সময়ে পবিত্র মোহন রায় আজাদ ভারতীয় সেনাবাহিনীর মহিলা এবং পুরুষ উভয় গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান ছিলেন। কিন্তু এই মহিয়সী নারী আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রথম গুপ্তচর হওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন। স্বয়ং নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু নিজেই নীরাকে এই দায়িত্ব দিয়েছিলেন।
এসময় ফৌজের ঝাঁসি রেজিমেন্টের নেতৃত্বে ছিলেন লক্ষী সায়গল। ১৯৪৩ সালে দক্ষিণ এশিয়ায় বসবাসকারী ভারতীয় বংশদ্ভুত মহিলা স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে গড়ে উঠেছিল এই রেজিমেন্ট। ব্যাংকক, রেঙ্গুন ও সিঙ্গাপুরে ছিল ট্রেনিং ক্যাম্প। এই রেজিমেন্টের সবাইকে মার্শাল আর্ট, মাইন পাতা, গ্রেনেড ছোড়া, আগ্নেয়াস্ত্র ও বেয়নেট চালানো শিখতে হতো। আজাদ হিন্দ ফৌজের শক্তিশালী গোয়েন্দা বিভাগের সূচনা হয়েছিল নীরা আর্যকে দিয়েই।
নীরা আর্যের সঙ্গী ছিলেন মনবতী আর্য, সরস্বতী রাজামণি, দুর্গা মল্লা গোর্খাসহ আরও অনেক বীরাঙ্গনা এবং যুবক ড্যানিয়েল কালে। তারা তাঁর সামরিক গোয়েন্দা শাখার সাথে যুক্ত ছিলেন। তাঁরা নেতাজির জন্য গুপ্তচরবৃত্তির কাজ করতেন। তাঁরা তথ্য সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন কাজের অছিলায় ব্রিটিশ অফিসারদের বাড়ি ও সেনাশিবিরে প্রবেশ করতেন। তারপর তা নেতাজির কাছে পাঠানো হত। এই কাজ অত্যন্ত বিপদজনক ছিল। কারণ এ কাজ করতে গিয়ে ধরা পড়লে প্রথমে নথিগুলি আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হতো এবং পরে পিস্তল চালিয়ে আত্মহত্যা করতে হবে। এই নিয়ম তাঁরা কঠোর ভাবে মেনে চলতেন এবং জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতেন।
একদিন সামান্য অসতর্ক হওয়ায় গুপ্তচরবৃত্তি করতে গিয়ে ব্রিটিশদের হাতে ধরা পড়ে যান দুর্গা মল্ল গোর্খা। কিন্তু সেদিন তিনি আত্মহত্যা করার সুযোগ পাননি। ধরা পড়ে যান ব্রিটিশদের হাতে। শুরু হয় তাঁর উপর অমানুষিক অকথ্য অত্যাচার। তাঁর কাছে ব্রিটিশরা বারবার নেতাজীর সন্ধান জানতে চায়। এদিকে নীরা আর্য ও স্বরস্বতী দুজনে বৃহন্নলা সেজে ব্রিটিশ শিবিরে ঢুকে পড়ে। তাঁরা নাচ ও গান করে সাহেবদের মনোরঞ্জন করতে শুরু করেন ও সুযোগ বুঝে আফিম মিশিয়ে দেন তাদের সুরার পাত্রে। অফিসাররা যখন নেশায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে তখনই দুর্গাকে শিকল মুক্ত করে সেনাছাউনির বাইরে নিয়ে আসা হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এক সেনা তাঁদের দেখে ফেলে ও গুলি চালায়। সেই গুলি লাগে স্বরস্বতীর পায়ে। আহত ও রক্তাক্ত স্বরস্বতীকে নিয়ে নীরা ও দুর্গা বিপদসঙ্কুল গভীর বনে হারিয়ে যায়। তাঁরা জানতেন যে, সাহেবরা কিছুক্ষণ পরেই জঙ্গলে চিরুনি তল্লাশি চালাবে। এজন্য তাঁরা তখন একটু উঁচু গাছে আশ্রয় নেন।
ব্রিটিশদের জঙ্গল তোলপাড় করার আওয়াজ কিছুক্ষণ পরেই তাঁদের কানে ভেসে আসে। কিন্তু ব্রিটিশ সেনারা কল্পনাও করতে পারেনি গুলিবিদ্ধ এক নারী তাঁর দুই সঙ্গীকে নিয়ে উঁচু গাছে পাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকতে পারে। একটু পরেই ব্রিটিশ সেনারা হতাশ হয়ে ফিরে যায়। নীরা ও তাঁর সঙ্গীদের গাছের ওপরেই কেটেছিল তিনদিন। তাঁদের মুখে একফোঁটা অন্নজলও জোটেনি এই সময়। তাঁরা পালা করে ঘুমিয়ে নিতেন তিনজন। এদিকে স্বরস্বতীকে নিয়ে নীরা ও দুর্গার চিন্তা বাড়তে লাগল। কারণ তাঁর পায়ের ক্ষত ক্রমশঃ বিষিয়ে যাচ্ছিল। অবশেষে তাঁরা গাছ থেকে নেমে পড়েন। পথ হারানোর আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও গভীর জঙ্গলে তাঁরা চলা শুরু করেন। তাঁরা তিনজনই ছিল অরণ্যযুদ্ধের প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত।
অবশেষে কিছুদিন পর তাঁরা আজাদ হিন্দ বাহিনীর গোপন ডেরায় পৌঁছান। গভীর জঙ্গলে থাকাকালীন বুনোফল ও ঝর্ণার জল ছাড়া তাঁদের কিছুই জোটেনি। ক্যাম্পে পৌঁছানোর পরই শুরু হল স্বরস্বতীর চিকিৎসা। স্বরস্বতীও ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলেন। নেতাজি এই কাজে খুব খুশি হয়ে তাদের পুরস্কৃত করেছিলেন। স্বরস্বতীর রাজমণি হয়েছিলেন ঝাঁসি বাহিনীর ‘লেফটেন্যান্ট’ ও নীরা আর্য হয়েছিলেন ‘ক্যাপ্টেন’।
নীরার স্বামীর সঙ্গে মতাদর্শগত কোনও মিল ছিল না। এদিকে শ্রীকান্ত জয়রঞ্জন দাস ছিলেন ইংরেজ ভক্ত অফিসার আর নীরা ছিলেন নেতাজি এবং স্বদেশের প্রতি একনিষ্ঠ। ব্রিটিশ সরকার শ্রীকান্ত জয়রঞ্জন দাসকে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর পিছনে নজরদারির দায়িত্ব দিয়েছিল। তাঁকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল সুযোগ পেলে নেতাজিকে হত্যা করার। একবার নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুকে হত্যার জন্য গুলি চালায় ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর পদস্থ অফিসার শ্রীকান্ত জয়রঞ্জন দাস। সৌভাগ্যবশত সেই গুলি নেতাজিকে বিদ্ধ করে নি কিন্তু গাড়ির চালককে বিদ্ধ করে। কিন্তু শ্রীকান্তের চেষ্টা ব্যর্থ করে দেন তাঁর স্ত্রী নীরা। সেখানে সেই মুহূর্তে উপস্থিত ছিলেন আজাদ হিন্দ ফৌজের রানি ঝাঁসি রেজিমেন্টের সদস্য নীরা আর্য। তিনি জয়রঞ্জনকে দ্বিতীয় সুযোগ দেননি। নীরা শ্রীকান্তের পেটে বেয়নেট চালিয়ে তাঁকে হত্যা করেন চোখের পলকেই। তবে শুধু এটুকুই তাঁকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য যথেষ্ট ছিল। নিমেষেই চোখের পলকে নিজের সিঁথির সিঁদুর মুছে ফেলেন সংগ্রামী সাহসী এই নারী।
তিনি ইংরেজদের পক্ষ অবলম্বনকারী নিজের স্বামীকে হত্যা করতেও দ্বিধা বোধ করেননি। এই ঘটনায় অভিভূত হয়ে নেতাজি নীরাকে ‘নাগিনী’ নামে অভিহিত করেছিলেন। তাঁর এই ত্যাগ চিরস্মরণীয়।
আরও পড়ুন# এপিজে আবদুল কালাম : ভারতের মিসাইল ম্যান!
নীরা আর্য এর প্রতি অত্যাচার:
দক্ষিণ এশিয়ার অক্ষশক্তির পরাজয়ের পর আজাদ হিন্দ ফৌজ ছত্রভঙ্গ হয়ে গিয়েছিল। আজাদ হিন্দ ফৌজের হাজার হাজার সেনানী আত্মসমর্পণ করেছিলেন। লালকেল্লায় তাঁদের বিচার শুরু হয় রাষ্ট্রদ্রোহীতার অপরাধে। বেশির ভাগ সেনানী মুক্তি পান। তবে স্বামী হ’ত্যার অপরাধে নীরাকে যাবৎজীবন করাদণ্ডে দণ্ডিত করে জাহাজে করে পাঠানো হয় আন্দামানের সেলুলার জেলে। সেখানে তাঁর উপর যে অমানুষিক অমানবিক অত্যাচার করা হয়েছিল সত্যিই তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।
নীরাকে আন্দামানে একটি ছোটো কুঠরিতে রাখা হয়েছিল। বাকি বন্দিদের মুক্ত অবস্থায় রাখা হলেও, নীরাকে প্রথমদিন বেঁধে রাখা হয়েছিল বন্য জন্তুর মত। গলায় চেন বাঁধা ছিল ও হাতে ও পায়ে ছিল শিকল লাগনো বেড়ি। নীরাকে প্রথম দিন কিছু খেতে দেওয়া হয়নি। প্রথমে শোয়ার জন্য মাদুর কিংবা কম্বল কিছুই জোটেনি। পরিশ্রান্ত নীরা তাই কুঠরির কনকনে ঠাণ্ডায় ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। এক প্রহরী মাঝরাতে কুঠরিতে ঢুকে গায়ের ওপর ছুঁড়ে দিয়েছিল দুটো কম্বল। সকাল বেলায় প্রথম ফুটন্ত খিচুড়ি জুটেছিল খাবার হিসেবে।
এরপর ব্রিটিশ জেলার একজন কামারকে সঙ্গে নিয়ে কুঠরির মধ্যে ঢুকে ছিলেন। কামার তাঁর হাতের বেড়ি কাটতে শুরু করে, যার ফলে হাতের চামড়া কেটে উঠে এসেছিল। নীরা বুঝতে পারছিলেন, ব্রিটিশ প্রভুভক্ত কামার ইচ্ছে করেই তাঁকে আঘাত করছে। তবুও তিনি দাঁতে দাঁত চিপে অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করছিলেন। কিন্তু যখন পায়ের বেড়ি কাটতে যায় তখন ইচ্ছে করেই হাতুড়ি দিয়ে পায়ে আঘাত করলে নীরা চিৎকার করে ওঠেন। বলতে থাকেন, ‘তুমি কি অন্ধ? পায়ে হাতুড়ি মারছো কেন?’ কামার নীরার বুকের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ‘দরকার হলে তোমার বুকেও মারতে পারি, তুমি কিছুই করতে পারবে না।’
নীরা রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলেছিলেন, ‘আমি জানি আমি তোমাদের ক্রীতদাস, তোমরা যা খুশি করতে পারো আমাকে নিয়ে।’ এরপর একদলা থুতু কামারের মুখের ওপর ছুঁড়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘মহিলাদের সম্মান করতে শেখো।’
জেলার ঘটনাটি উপভোগ করছিলেন। নীরার সামনে এসে বললেন, ‘নেতাজি কোথায় বলে দাও, আমরা তোমাকে ছেড়ে দেব।’ ভাবলেশহীন মুখে নীরার সেদিন জবাব ছিল, ‘সারা বিশ্ব জানে যে নেতাজি বিমান দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন।’ উত্তেজিত জেলার চিৎকার করে ওঠেন, ‘তুমি মিথ্যে কথা বলছ, সুভাষ বোস এখনও জীবিত।’ মাথা উঁচু করে নীরা সগর্বে বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ নেতাজি বেঁচে আছেন আমার বুকে।’
জেলার ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে বলেছিলেন, ‘সুভাষ বোস যদি তোমার বুকে থাকে, তাহলে সেখান থেকে আমরা তাঁকে বের করে আনব।’ এরপর নীরাকে অমানুষিকভাবে মারতে শুরু করে জেলারও তাঁর জামা ছিঁড়ে দেয়। দু’হাতে নীরার দুই স্তন মুচড়ে ধরে ইশারা করেছিলেন কামারের দিকে। কামার তার বাক্স থেকে বের করেছিলেন ‘ব্রেস্ট রিপার’। নারীদের ওপর অত্যাচার করার একটি মধ্যযুগীয় যন্ত্র এটি। দেখতে অনেকটা সাঁড়াশির মতন, এটি আগুনে গরম করে নারীদের স্তন উপড়ে নেওয়া হতো। কামার ‘ব্রেস্ট রিপার’ যন্ত্রটিকে নীরার ডান স্তনে বসিয়ে প্রবল চাপ দিতে শুরু করে। জেলার নীরার ঘাড় দুই হাতে শক্ত করে ধরে রেখেছিল।
নীরার আর্ত চিৎকার বোধ হয় সেলুলার জেলে বন্দি থাকা সকল কয়েদি শুনতে পেয়েছিলেন। ব্রেস্ট রিপার দিয়ে নীরার ডান স্তন কামার উপড়ে নিয়েছিল। রক্তাক্ত নীরা জ্ঞান হারাবার আগে কানের কাছে শুনতে পেয়েছিলেন জেলারের কণ্ঠ, ‘ফের মুখে মুখে তর্ক করলে অন্য স্তনটিও ওপড়ে নেওয়া হবে, ধন্যবাদ দাও রানি ভিক্টোরিয়াকে, যে ব্রেস্ট রিপারটি আগুনে গরম করা ছিল না।’
এরপরেও নীরাকে আরও অনেক পাশবিক অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। সারা শরীর ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গিয়েছিল। তবুও তিনি মনে মনে স্বপ্ন দেখতেন স্বাধীন ভারতে সূর্যোদয় দেখবেন। এই মহান ত্যাগের সম্মান দেয়নি দেশ। নীরা আন্দামানে আসার এক বছর পর স্বাধীন হয়েছিল দেশ। মুক্তি পেয়েছিলেন নীরা। সম্মান না পেয়ে অভিমানে জনতার ভিড়ে হারিয়ে যান অসাধারণ এই লড়াহু নারী।
নীরা আর্য এর পরবর্তী জীবন:
ভারত স্বাধীন হবার বহু বছর পর নীরা আর্যকে হায়দরাবাদের ফলকনামা এলাকায় খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। স্বাধীন ভারতে ফুল বেঁচে পেট চালাতেন তিনি। থাকতেন বস্তির এক চালা ঘরে। সরকারি জমিতে থাকার ফলে তাঁর কুঁড়েঘরটিও শেষ মুহুর্তে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। বস্তির লোকেরা তাঁকে পেডাম্মা (ঠাকুমা) বলে ডাকতেন। তাঁর পরিচয় জানা গেলে পরবর্তী সময়ে নীরাকে সরকারি পেনশন দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয় কিন্তু তিনি তা ফিরিয়ে দেন।
বই ও স্মরণ:
নীরা আর্য রচিত বই হলো:
- আমার জীবন সংগ্রাম, হিন্দ পকেট বই, প্রথম সংস্করণ ১৯৬৮।
- আন্দামানের অনন্য অনুশীলন।
নীরা আর্য’কে নিয়ে লেখা বইসমূহ:
- আজাদ হিন্দ ফৌজের নামবিহীন সৈনিক, মনমথনাথ গুপ্ত, হিন্দ পকেট বই, সংস্করণ ১৯৬৮।
- ভুলি বিসরি ঐতিহাসিক গল্প, তেজপাল সিংহ ধামা, সূর্য ভারতী প্রকাশ চাওয়াদি বাজার নয়াদিল্লি, সংস্করণ ২০১২।
- আজাদ হিন্দের প্রথম গুপ্তচর, হিন্দ পকেট বুকস, সংস্করণ ২০০৪।
- আজাদ হিন্দের প্রথম গুপ্তচর, মধু ধামা, সাগর প্রকাশন, শাহদারা দিল্লি, সংস্করণ ২০১৮।
- এই গোয়েন্দা মহিলা, সত্যদেব নারায়ণ সিনহা হিন্দ পকেট বই, সংস্করণ ১৯৬৮।
- ভারতীয়া কিষাণ ইউনিয়ন, হুক্কা থেকে হক, ডাঃ রণজিৎ সিং, সাগর পাবলিকেশনস, সংস্করণ ২০১৮।
- নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু, নির্মল বোস, অক্ষর পাবলিকেশনস, ১৯৭৮ সংস্করণটির অজানা অংশীদার।
মৃত্যুপরবর্তী সময়ে স্মরণ:
তিনি বেঁচে থাকাকালীন তাকে কোনো সম্মাননা দেওয়া হয়নি কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর নামে একটি জাতীয় পুরস্কার চালু করা হয়েছে। তাঁর জীবন নিয়ে চলচ্চিত্রও হয়েছে। এছাড়াও লোককবিদের মুখে মুখে ‘নীরা নাগিনী’-কে নিয়ে রচিত হয়েছে অনেক গান।
জীবনাবসান:
নীরা আর্য হায়দরাবাদের ফালকনুমার একটি কুঁড়ে ঘরে বাস করতেন। বার্ধক্যজনিত অবস্থায় ১৯৯৮ সালের ২৬শে জুলাই, রবিবার চারিমিনারের নিকটে ওসমানিয়া হাসপাতালে দরিদ্র, অসহায়, নিঃস্ব অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। স্থানীয় মানুষেরা তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন করায়।
পরিশেষে বলা যায়, নীরা আর্য এক ভয় না পাওয়া দুঃসাহসী নারীর নাম, যিনি স্বাধীনতার জন্য নিজের স্বামীকে হত্যা করেছেন, সহ্য করেছেন ব্রিটিশদের অকথ্য অমানবিক নির্যাতন। আজাদ হিন্দ ফৌজের বীর সেনানী নীরা আজও অমর হয়ে আছেন তাঁর এই অসামান্য কীর্তির জন্য। কিন্তু তাঁর যতটা প্রচার বা সম্মান প্রাপ্য, ততটা পাননি ভারতের এই বীরাঙ্গনা। তবুও ইতিহাস নীরা আর্যের মতো বীর সাহসী নারীর ঋণ কখনই শোধ করতে পারবে না।