বোট স্কুল নাম শুনে অবাক হচ্ছেন? স্কুল বলতে আমরা বুঝি খোলা মাঠের সামনে একটি বা তার বেশি ভবন যার মধ্যে রয়েছে বেশকিছু শ্রেণিকক্ষ ও অফিসরুম। সাথে ইউনিফর্ম পরা ছাত্রছাত্রীদের চেঁচামেচি, হইচই! কেউ বা ক্লাসরুমে বই কিংবা হোমওয়ার্কের খাতায় মুখ গুঁজে আছে। আবার কেউ কেউ খেলার মাঠে সজোরে ব্যাট চালাচ্ছে, কেউ আবার ফুটবলে লাথি মেরে বল পাঠিয়ে দিচ্ছে গোলবারের ভেতরে। আবার কেউ কেউ ভীড় করে দাঁড়িয়ে আছে স্কুল ক্যান্টিনের সামনে। তাদের হাতে সিঙ্গারা, সমুচা কিংবা প্যাটিস শোভা পাচ্ছে। কিন্তু যদি গতানুগতিক এই স্কুলের ধারণাকে পাশ কাটিয়ে নতুন কিছু ভাবতে শুরু করি, তবে কি অবাক হবেন? আচ্ছা, আপনারা কখনো ভাসমান স্কুল বা বোট স্কুলের কথা শুনেছেন? হ্যাঁ, এমন ভাসমান স্কুল কিন্তু আমাদের দেশেই আছে! সাধারণত বড়ো আকৃতির নৌকায় বসে এসব অস্থায়ী স্কুল। চলুন আজ বরং জেনে নিই ভাসমান স্কুল তথা বোট স্কুলের আদ্যোপান্ত!
বোট স্কুল
বোট স্কুল কী?
সাধারণত নৌকায় বসা ভাসমান ও অস্থায়ী স্কুলগুলোকেই আমরা বোট স্কুল নামে চিনি। বোট স্কুল সাধারণত একটি নির্দিষ্ট স্থানে বসে না। নদীর তীরে নৌকাকে নোঙ্গর করিয়ে কিংবা বেঁধে রেখে বানানো হয় বোট স্কুল। অবশ্য যেন তেন নৌকা হলে হবে না। চাই ছইওয়ালা বড় আকৃতির নৌকা। যেখানে মোটামুটি ৩০-৫০ জন শিক্ষার্থী একসাথে বসে পড়াশোনা করতে পারবে! সাথে থাকবে আলোর ব্যবস্থা, বইপত্র রাখার তাক, একখানা ব্ল্যাক/হোয়াইট বোর্ড। ব্যস, এইটুকুই! সাদামাটা বোট স্কুল বলতে যা বোঝায় তা এরচেয়ে বেশিকিছু নয়। জাঁকজমক কিংবা জৌলুস না থাকলেও এই বোট স্কুল কিন্তু বেশ গুরুত্বপূর্ণ। হোজ তার নির্দিষ্ট জায়গা নেই, হোক তা অস্থায়ী, তবুও পিছিয়ে পড়া জনপদগুলোতে আলোর দিশারী হয়ে উঠেছে এই ভাসমান স্কুলগুলো!
বোট স্কুলের প্রয়োজনীয়তা
বোট স্কুল বানানোর পেছনের কারণটা জানতে হলে আপনাকে জানতে হবে ভাসমান জনগোষ্ঠীর জীবনের গল্প! রাস্তাঘাটে কিংবা নদীর ধারে নিশ্চয়ই ভূমিহীন ও পিছিয়ে পড়া বেদে সম্প্রদায়ের মানুষদের আপনি নিশ্চয়ই দেখেছেন। এই পিছিয়ে পড়া মানুষগুলোর না আছে বাড়িঘর, না আছে নির্দিষ্ট জমিজমা! এই মানুষগুলোর জীবন ও জীবিকা সবকিছুই যেন ভাসমান। তাদের নেই নির্দিষ্ট কোনো আয়ের উৎস। বুজরুকি, সাপের খেলা দেখানো কিংবা ওষুধি গাছ গাছড়া বা জরিবুটি বিক্রি করে কোনোমতে চলে তাদের সংসার। এসব পিছিয়ে পড়া মানুষগুলোর জীবন কাটে নৌকাতেই। কিংবা নদীর পাড় ঘেঁষে বানানো অস্থায়ী বস্তিতে। ভেসে থাকাই যেন তাদের জীবন। আজ এখানে তো কাল ওখানে, এটাই যেন নিয়তি! জন্ম থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনের পুরোটা সময়ই কেটে যায় ভাসমান অবস্থায়। ভাসমান অবস্থায় যাযাবরের জীবনের জন্যেই বেদে সম্প্রদায়ের শিশুরা পেতো না শিক্ষার সুযোগ। এ যেন আধুনিক সময়ে এসেও পিছিয়ে পড়ার এক অদ্ভুতুড়ে নিয়ম। এ সমস্যা থেকে বাঁচতেই এলো বোট স্কুলের ধারণা। ভাসমান বলে এই স্কুলকে যখন খুশি যেখানে নিয়ে যাওয়া যায়। বেদে সম্প্রদায়ের আর সবকিছুর মতো স্কুলগুলোও হয়ে গেল যাযাবর!
আরও পড়ুন# বাইশ বছর ধরে গোসল করেন না ধর্মদেব!
বোট স্কুল পরিচালনা করেন যারা
এখন পর্যন্ত দেশের প্রায় ২৬ টি জেলায় বোট স্কুল চালু করা হয়েছে। উত্তরাঞ্চলে, বিশেষ করে যমুনা ও তিস্তা পাড়ের প্রত্যন্ত জনপদের বানভাসি মানুষের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়েছে এই বোট স্কুলগুলো। তবে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা নয়, এর পেছনে পুরো অবদান কিন্তু বেসরকারি সংস্থাগুলোর। এর মধ্যে ব্রাকের কথা উল্লেখ না করলেই নয়! ব্র্যাকের শিক্ষাতরী নামের বোট স্কুল শিক্ষার আলো ছড়িয়েছে প্রান্তিক জনপদে। আগে যেখানে শিক্ষার নামগন্ধও ছিল না, সেখানে এই ভাসমান স্কুলগুলোই স্কুলমুখী করেছে বাচ্চাদের। পাশাপাশি বন্যার সময়ের বিভিন্ন নির্দেশনাও দেওয়া হতো এসব স্কুলগুলোতে।
বাংলাদেশের অন্যতম তরুণ স্থপতি মোহাম্মদ রেজওয়ান আহমেদ। তিনি ১৯৯৮ সালে গড়ে তুলেছিলেন সিধুলাই স্বনির্ভর সংস্থা নামের একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। সেই সিধুলাই গ্রামটি ছিল বন্যাকবলিত। বছরের বেশিরভাগ সময় জায়গাটি বিল ও বন্যার পানিতে ডুবে থাকে। তাই রেজওয়ান স্বপ্ন দেখলেন একটি ভাসমান স্কুল বানাবেন। ২০০২ সালে এই স্কুল যাত্রাও শুরু করে। তিনি তার বৃত্তির বাইশ হাজার টাকার পুরোটাই খরচ করেছিলেন এই ভাসমান স্কুল নির্মাণে।
আরও পড়ুন# জামদানি শাড়িতে উষ্ণ সোহিনী, জেনে নিন জামদানির ইতিহাস!
২০০৫ সালে মোহাম্মদ রেজয়ান একটি অবিশ্বাস্য সুসংবাদ পেলেন। তার দীর্ঘমেয়াদি স্বপ্ন বড় আকারে সম্প্রসারণের জন্য তাকে এক মিলিয়ন ডলার দেওয়া হবে। বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন থেকে প্রাপ্ত পুরস্কারের অর্থ রেজোয়ানের এই ছোট প্রতিষ্ঠানটির কর্মপরিধি বৃদ্ধিতে সহায়তা করে, নৌকার কলেবর বৃদ্ধি পায়, সব নৌকায় সৌরবিদ্যুৎ এবং ইন্টারনেটসহ কম্পিউটার আনা হয়। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটির কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিটিতে পঞ্চাশ হাজার বই ও একশটিরও বেশি কম্পিউটার আনা হয়। বিল গেটস ফাউণ্ডেশনের উদারতায় এখন বাংলাদেশের ভাসমান স্কুলের শিক্ষার্থীরা সৌরশক্তির মাধ্যমে কম্পিউটার ও ইন্টারনেট সুবিধা পাচ্ছে। এই বর্ষা এবং বন্যায় বিধ্বস্ত অঞ্চলেও শিশুরা শিক্ষা সুবিধা পেয়েছে।
শেষ কথা
শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। প্রতিটি দেশের প্রতিটি নাগরিকেরই শিক্ষা লাভের অধিকার রয়েছে। আমরা যারা আধুনিক সমাজে জীবনযাপন করছি, তাদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়ানো তুলনামূলক সহজ একটি কাজ ছিল। সভ্যতার বিস্তারের সাথে সাথে জ্ঞানচর্চার মাধ্যম থেকে শুরু করে আধুনিক সময়ের স্কুল কলেজ, সবই নির্মিত হয়েছে মূল ধারার মানুষের কথা মাথায় রেখে। যাযাবর শ্রেণির মানুষগুলোর কথা কেউ ভাবেনি। যে কারণে আমরা যখন শিক্ষিত হয়ে নিত্যনতুন উদ্ভাবনকে কাজে লাগিয়ে কাজে লাগিয়ে জীবনকে করেছি সহজতর, তখন আমাদের সমাজেরই একটি পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী দিনের পর দিন বঞ্চিত হয়েছে শিক্ষার অধিকার থেকে। তাই স্থপতি রেজওয়ান আহমেদকে এমন কাজের জন্যে ধন্যবাদ দিতেই হয়!