ফিচারবিজ্ঞানবিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

বুদ্ধিমান অক্টোপাসের গল্প!

বুদ্ধিমান অক্টোপাসের গল্প! এই পৃথিবীর পরতে পরতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে জীব-বৈচিত্রের নানা সমাহার। আমরা স্থল্পভাগের প্রাণিকুল সম্পর্কে অনেকটাই জানি, কিন্তু পানির অতলের প্রাণিদের নিয়ে জানাটা যেন খুব কথা কমই!

বুদ্ধিমান অক্টোপাসের গল্প! এই পৃথিবীর পরতে পরতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে জীব-বৈচিত্রের নানা সমাহার। আমরা স্থল্পভাগের প্রাণিকুল সম্পর্কে অনেকটাই জানি, কিন্তু পানির অতলের প্রাণিদের নিয়ে জানাটা যেন খুব কথা কমই! সমুদ্র কিংবা নদীর বিপুল জলের তলদেশে রয়েছে অসংখ্য জীবের বসবাস, যাদের সম্পর্কে প্রতিনিয়ত নিত্যনতুন অনেক তথ্যই বের হচ্ছে বিজ্ঞানের কল্যাণের। কেবল যে অপরিচিত প্রাণির মধ্যেই রহস্য তা নয়, চেনা জানা প্রাণিদেরও দিনকে দিন খোলস খুলে বের হচ্ছে আশ্চর্য সব তথ্য। তৈরি হচ্ছে মানুষের বিস্ময়। আজ তেমনই এক প্রাণি নিয়ে আমাদের এই আর্টিকেল। যে প্রাণি তার আট পায়ে সমুদ্রের তলদেশ ধাপিয়ে বেড়ায়। হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন। বলছি মলাস্কা পর্বের আমাদের অতি পরিচিত প্রাণি অক্টোপাস নিয়ে। বিজ্ঞানীদের এই অক্টোপাসকে নিয়ে যেন আগ্রহের শেষ নেই। তো চলুন আজ আমরা জানব—বুদ্ধিমান অক্টোপাসের গল্প!

•হৃৎপিণ্ডঃ আমরা জানি, মানুষসহ অনেক প্রাণিরই হৃৎপিণ্ড কেবল একটি, কিন্তু আপনি শুনলে অবাক হবেন যে, অক্টোপাসের রয়েছে তিনটি হৃৎপিণ্ড। এর মধ্যে দুইটি হৃৎপিণ্ড অক্টোপাসের ফুলকায় রক্ত সঞ্চালন করতে সাহায্য করে এবং তৃতীয় হৃৎপিণ্ড অক্টোপাসের শরীরের বাকি সব অঙ্গগুলোতে রক্ত সঞ্চালন করা কাজে নিয়োজিত থাকে। আর অক্টোপাসের রক্তে মানুষের মতো হিমোগ্লোবিন থাকে না, থাকে হিমোসায়ানিন।
অক্টোপাসের তিনটি হৃৎপিণ্ড একটি হৃৎপিণ্ডের চেয়ে তিনগুন বেশি রক্তচাপ তৈরি করতে সক্ষম। এর ফলে এই হৃৎপিন্ডগুলো রক্ত সঞ্চালনের মাধ্যমে অক্টোপাসের শরীরে অক্সিজেন সরবরাহ বজায় রাখে। তবে অক্টোপাসের তিনটি হৃৎপিণ্ড যে সব সময় কাজে লাগে, এমন না। অক্টোপাস যখন সাতার কাটে তখন যে হৃৎপিণ্ড তার পুরো শরীরে রক্ত সরবরাহ করেছিল, সেটা কাজ করা বন্ধ করে দেয়।৷ আর এই কারণেই অক্টোপাস চলাফেরা করতে সাঁতার কম কাটে এবং হামাগুড়ি দিয়ে বেশি চলে।

•রক্তের রঙঃ সাধারণত মেরুদণ্ডী প্রাণিদের রক্তের রঙ লাল হয়, কিন্তু অক্টোপাসের রক্তের রঙ নীল। মেরুদণ্ডী প্রাণিদের রক্তের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো তাদের লোহিত রক্ত কণিকাতে আয়রনযুক্ত হিমোগ্লোবিনের উপস্থিতি। আর এই হিমোগ্লোবিনের জন্যই রক্ত লাল রঙয়ের হয়। কিন্তু, আমরা একটু আগেই জেনেছি, অক্টোপাসের রক্তে হিমোগ্লোবিন থাকে না, বরং এর পরিবর্তে থাকে কপারযুক্ত হিমোসায়ানিন নামক এক ধরনের রঞ্জক পদার্থ, যা অক্টোপাসের রক্তে দ্রবীভূত অবস্থায় থাকে। আর এই হিমোসায়ানিনই মূলত অক্টোপাসের রক্ত নীল হওয়ার কারণ।

প্রিয় পাঠক, তবে মনে প্রশ্ন জাগতে পারে—অক্টোপাসের রক্তে হিমোসায়ানিনের পরিবর্তনে হিমোগ্লোবিন থাকলে কী হতো?

অবশ্য এইক্ষেত্রে সমস্যা একটা রয়েছে। অক্টোপাস সাধারণত সমুদ্রের গহীন তলদেশে বিচরণ করে, কখনো উপরিভাগে তেমন ভেসে থাকতে দেখা যায় না। আমরা জানি, গভীর সমুদ্রের তলদেশের পরিবেশ তুলনামূলক ঠাণ্ডা। সেখানে অক্সিজেনের ঘনত্ব থাকে খুবই কম। আর ওই পরিবেশে হিমোসায়ানিন খুব দক্ষতার সাথে অক্সিজেন পরিবহনের কাজ করে। এছাড়াও এই হিমোসায়ানিনের কার্যকারিতা পানির অম্লতা বা লবণের ওপর অনেকটা নির্ভরশীল। তো, যদি পানির অম্লতা খুব বেশি হয়, তখন অক্টোপাসের শরীরে অক্সিজেন সংবহন করা অক্টোপাসের জন্য বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। তবে দিন দিন জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রের পানির অম্লতার পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে, তখন সামুদ্রিক প্রাণিদের কী হাল হবে! এই নিয়ে বিজ্ঞানীরা অবশ্য বেশ দুশ্চিন্তায় আছেন।

•অক্টোপাস সম্পর্কে এরিস্টটলঃ গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটলের মতে, অক্টোপাস খুবই বোক এবং সহজ-সরল প্রাণি। তিনি তার ‘হিস্ট্রি অব অ্যানিমেলস’ বইয়ে খ্রিষ্টপূর্ব ৩৫০ অব্দে উল্লেখ করেছিলেন—অক্টোপাস হলো নিরেট স্থূল বুদ্ধির এক প্রাণি। এটা সমুদ্রের ওপরের দিকে ওঠে আসলে খুব সহজেই মানুষের হাতে মারা পড়বে। কিন্তু, বাস্তবে অক্টোপাস অত্যন্ত বুদ্ধিমান এক প্রাণি এবং মানুষের মতোই হাতিয়ার বানিয়ে অক্টোপাস নানা ধরনের কাজ সম্পন্ন করতে পারে। যদি একটি বোতলে মুখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ একটি অক্টোপাসকে আটকে রাখা হয়, তা কিছু সময়ের মধ্যেই খুলে ফেলতে পারে। এছাড়াও বিভিন্ন ধরনের ধাধার সমাধান দিয়ে অক্টোপাস দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে।

•চোষকের সংবেদনশীলতাঃ নিউরন কোথায় থাকে! উত্তর হবে মাথায়। কিন্তু, অক্টোপাসের বেলায় নিউরন তার মাথায় থাকে না, থাকে তার বাহুগুলোতে। শুনতে অবাক হলেও, একটি অক্টোপাসে বিদ্যমান মোট নিউরনের দুই-তৃতীয়াংশ নিউরনই থাকে অক্টোপাসটির বাহুগুলোতে। আর এইজন্য অক্টোপাস অন্য কোনো কাজে ব্যস্ত থাকলেও, তার বাহুগুলো মস্তিষ্কের নির্দেশ ছাড়াই পরিস্থিতি বুঝে বিভিন্ন কাজ সম্পন্ন করে থাকে। এছাড়াও অক্টোপাসের প্রতিটি বাহুতে ২৪০ টি করে চোষক থাকে এবং প্রতিটি চোষক প্রায় ৩০ পাউন্ড অবধি ভার বহন করতে পারে।
অক্টোপাসের চোষকগুলো খুবই সংবেদনশীল হয়। আর এই কারণেই অক্টোপাসের শরীর থেকে চোষক বিচ্ছিন্ন করলেও সেগুলো নড়াচড়া করতে পারে। এক গবেষণায়, বিজ্ঞানীরা অক্টোপাসের শরীর হতে বাহুগুলো আলাদা করে নিয়ে তাতে সূচালো কিছু দ্বারা আঘাত করেন। তারা দেখেন, আঘাত করার সঙ্গে সঙ্গে বাহুগুলো অন্যত্র সরে যায়।
অক্টোপাসের কর্ষিকা অক্টোপাস মারা যাওয়ার এক ঘণ্টা পরেও সক্রিয় থকে এবং সেগুলো পারিপার্শ্বিক উদ্দীপনায় সাড়াও দেয়। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, অক্টোপাস যদি মারাও যায়, কর্ষিকাগুলো এতটাই সংবেদনশীল যে, মারা যাওয়া অক্টোপাসের মুখের দিকে আশেপাশে খাবার পেলে তা এগিয়ে দেয়।

•শত্রু হতে নিজেকে বাঁচানোর কৌশলঃ অক্টোপাস শিকারির হাত থেকে বাঁচার জন্য এক প্রকার কালি ছুঁড়ে দেয়। এই কালি কেবল অক্টোপাসকে লুকাতেই সহায়তা করে না, বরং শিকারিকে শারীরিকভাবে ক্ষতিও করে। কারণ ছুঁড়ে দেওয়া কালিতে টাইরোসিনেজ নামক এক ধরনের পদার্থ থাকে। আর মানুষের ভেতর এই টাইরোসিনেজ প্রাকৃতিক রঞ্জক মেলালিন তৈরি করতে সাহায্য করে।

তো অক্টোপাস টাইরোসিনেজ রঞ্জক তার শক্রুর দিকে ছুঁড়ে মারলে শক্রু কিছু সময়ের জন্য অন্ধ হয়ে যায়। এছাড়াও এই কালির বিশেষ আরেকটি গুন হলো এটি শত্রুর ঘ্রাণশক্তি ও স্বাদ অনুভবের ক্ষমতা কিছু সময়ের জন্য নষ্ট করে দেয়। ফলে, অক্টোপাস কয়েক সেকেন্ডেই শক্রর চোখে ধুলো দিয়ে শক্রর সামনেই ছদ্মবেশে নিজেকে লুকিয়ে ফেলে।

মানুষের খাবার হিসাবে অক্টোপাস—উত্তর ও পশ্চিম আফ্রিকাতে সবচেয়ে বেশি অক্টোপাস খাওয়া হয়। এছাড়াও স্পেন, গ্রিস, আমেরিকা ও পূর্ব এশিয়াসহ প্রায় সমুদ্রের কাছাকাছি বসবাস করা প্রত্যেক দেশেই অক্টোপাস কম বেশি খাওয়া হয়। বর্তমানে বাংলাদেশেও অক্টোপাস বেশ জনপ্রিয়। তবে দক্ষিণ কোরিয়াতে জীবন্ত অক্টোপাদ বা স্যান-ন্যাক-জি একটি সুস্বাদু ও জনপ্রিয় খাবার। দক্ষিণ কোরিয়ানরা বিশ্বাস করে, গ্রীষ্মকালে অক্টোপাস খেলে তা শক্তি বৃদ্ধি করে। আবার, অনেকে মনে করেন জীবন্ত অক্টোপাস খেলে রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। তবে, অক্টোপাস স্যুপ, বারবিকিউ, মাশালাসহ বিভিন্ন উপায়ে খাওয়া হয় এবং অনেকেরই অক্টোপাসের স্বাদ খুব প্রিয়।

•ছদ্মবেশী অক্টোপাসঃ অক্টোপাস খুব ভালো ছদ্মবেশী। এক সেকেন্ডের দশ ভাগের তিন ভাগ সময়ে অক্টোপায়া নিজের শরীরের রঙ পরিবর্তন করতে পারে। সাধারণত বিপদের সম্মুখীন হলে কিংবা শিকার ধরার জন্য অক্টোপাস নিজেকে শৈবাল বা পাথরের মতো করে ছদ্মবেশ ধরে থাকে।

•বুদ্ধিমান অক্টোপাসঃ একটি অক্টোপাসের প্রায় ৫০০ মিলিয়ন নিউরন থাকে, যা কিনা একটা কুকুরের নিউরনের সমান। কিছুদিন আগে সিটেল একাডেমির প্রাণিবিদরা একটি পরীক্ষা করেন। তারা বিলি নামের একটি অক্টোপাসের শক্তি ও বুদ্ধির পরীক্ষা করেন। প্রথমে বিলিকে একটি বোতলের মধ্যে খাবার আটকে দেন। বিলি অবাক করে দিয়ে ৫ মিনিটের মধ্যে বোতলটি খুলে ফেলেন। তবে অক্টোপাসের জন্য এটা অতটা অবাকের নয়। কেননা, অক্টোপাস ছুরির সহায়তা ছাড়া শামুক ও ঝিনুকের খোলস খুলে ফেলে।

এছাড়াও পানির ভেতর তৈরি হওয়া নানা গোলকধাঁধা হতে খুব সহজে বের হয়ে যেতে পারে। এরা বুদ্ধিমানের পাশাপাশি, রসিকও বটে। এরা অনেক সময় দুষ্টুমি করে জেলেদের নৌকা অবধি আটকে দেয়। অক্টোপাস নারিকেলের খোসা, ঝিনুকের খোলসে বাসা বাঁধে আবার কাঁকড়ার খোলস ছাড়িয়ে তাদের মাংসও ভক্ষণ করে। এদের জানা আছে জার বা বোতল খোলার ব্যবস্থা৷ শুধু তাই নয়, এরা মানুষের মতো নখ খেয়ে বিষণনতাও কাটায়। অক্টোপাসের স্নায়ুতন্ত্র এবং মানুষের স্নায়ুতন্ত্র একদমই ভিন্ন। এছাড়া মানুষের মস্তিষ্কের আকারও বড়ো। কিন্তু, অক্টোপাস ভিন্ন ভিন্ন মানুষকেও চিনতে পারে। যা খুবই বিস্ময়কর।

•স্বচ্ছ অক্টোপাসের বিরল ছবিঃ পৃথিবী যেসব প্রাণির দেখা পাওয়া খুবই রিরল, এদের মধ্যে অন্যতম হলো গ্লাস অক্টোপাস। এই অক্টোপাসের পুরো শরীর কাঁচের মতো স্বচ্ছ হওয়ায় এদেরকে গ্লাস অক্টোপাস নামকরণ করা হয়েছে। এদের শরীর এতোটাই স্বচ্ছ যে তাদের শরীর ভেদ করে অপরদিকের পানি অনায়াসে দেখা যায়। তবে, সমুদ্রের নীল পানিতে এদের দেখা পাওয়া খুবই দুষ্কর। ১৯১৮ সালে সামুদ্রিক একটি শিকারি প্রাণির পেটে এই গ্লাস অক্টোপাসের প্রথম হদিস পাওয়া যায়। কিন্তু, এই নিয়ে বেশিদূর গবেষণা আগায়নি। এর অন্যতম কারণ অন্যান্য প্রাণিদের অনেক ফুটেজ থাকলেও এই স্বচ্ছ অক্টোপাসের তেমন একটা ফুটেজ নেই। কেবল এর বেলনাকার চোখ, অপটিক নার্ভ, পরিপাকতন্ত্র ব্যতীত দেহের অন্য সব অংশ কাঁচের মতো স্বচ্ছ।

প্রাণীদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণের জন্য ক্যালিফোর্নিয়া ভিত্তিক সমুদ্র গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্মিড্‌ট ওশান ইন্সটিটিউটের একটি গবেষক দল নামক একটি রোবট সমুদ্রের তলদেশে পাঠান। প্রশান্ত মহাসাগরের তলদেশে ৩০ হাজার বর্গমাইলের বেশি এলাকাজুড়ে ৩৪ দিন ধরে অভিযান চালিয়ে যান তারা। সেই রোবটের মধ্যে থাকা উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ক্যামেরার ফ্রেমে ধরা পড়ে বিরল একটি গ্লাস অক্টোপাস।

•মাই অক্টোপাস টিচারঃ দক্ষিণ আফ্রিকার ‘মাই অক্টোপাস টিচার’ প্রামাণ্যচিত্রটি ৯৩তম একাডেমি অ্যাওয়ার্ডে সেরা প্রামাণ্যচিত্রের খেতাবে ভূষিত হয়। সেই ডকুমেন্টারিটিতে চিত্রায়িত করা হয়েছিল গভীর সমুদ্রের তলদেশে অক্টোপাসের বৈচিত্র্যময় জীবনের গল্প। ডকুমেন্টারির প্রযোজক ক্রেইগ ফস্টার সমুদ্রের তলদেশে ঘোরাঘুরি করতে গিয়ে একটি অক্টোপাসের দেখা পান। মানুষ মানুষের প্রেমে পড়ে তাই শুনেছেন এতোদিন, কিন্তু প্রযোজক প্রেমে পড়েছিল সেই অক্টোপাসটির। এরপর, তিনি জেনে নেন কীভাবে অক্টোপাসের সাথে সম্পর্ক গড়া যায়, সে বিষয়ে বিস্তারিত। তিনি প্রায় এক বছর কঠোর প্রচেষ্টার পর অক্টোপাসটির সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়তে সক্ষম হোন এবং খুব কাছ থেকে দেখতে লাগলেনঅক্টোপাসরা কীভাবে খায়, ঘুমায় এবং বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করে।সেই অক্টোপাসটি প্রযোজক ক্রেইগের একঘেয়ে জীবনে বিচিত্রতা বয়ে এনেছিল। এছাড়াও তিনি দীর্ঘদিন ধরে ক্যামেরায় ভিডিও করেছেন অক্টোপাসের সাথে কাটানো সময়ের অসংখ্য স্মৃতি। আর সেই স্মৃতিগুলোকেই ইডিট করে তৈরি করেছেন ৮৫ মিনিটের একটি প্রমাণ্যচিত্র। যে প্রমাণ্যচিত্র ইতোনধ্যেই কেড়ে নিয়েছে হাজারো দর্শকের মন। আপনি চাইলে সিরিজটি নেটফ্লিক্সে দেখতে পারবেন।

•অক্টোপাসের স্বপ্নঃ একটি অক্টোপাস গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে। এই ঘুমের মধ্যেই সেটা অনবরত নিজের রং বদলাচ্ছে। কিছু সেকেন্ডের ব্যবধানে কখনো হলুদ হচ্ছে, কখনো আবার লালচে হয়ে যাচ্ছে। তার এই রং বদলানোর মনোরম দৃশ্য ক্যামেরায় বন্দী হলে, মুহূর্তের মধ্যেই তা ভাইরাল হয়ে যায়। যদিও গায়ের রঙ বদলানো অক্টোপাসের জন্য তেমন নতুন কিছু নয়। কিন্তু, এভাবে ঘুমের মধ্যে রঙ বদলানোটা জীববিজ্ঞানীদের জন্য ভাবনার বিষয় হয়ে ওঠেছে। অনেক বিজ্ঞানী মনে করছেন, ঘুমের সময় ওই অক্টোপাসটি হয়তো কাঁকড়া খাওয়া স্বপ্ন দেখছিলো।

•অক্টোপাসের যৌনমিলনঃ অক্টোপাস যৌনমিলনের সময় পুরুষ অক্টোপাসটি তার হেক্টোসোটাইলাস স্ত্রী অক্টোপাসের ম্যান্টল গহব্বরের মধ্যে ঢুকিয়ে এর মধ্যে স্পার্মাটোফোর জমা করে। হেক্টোসীটাইলাস হলো পুরুষ অক্টোওয়াসের একটি পরিবর্তিত বাহু, যেটি দিয়ে পুরুষ অক্টোপাস স্ত্রী অক্টোপাসের শরীরে শুক্রাণু বা বীর্য স্থানান্তর করে। অক্টোপাসদের এই মিলন প্রক্রিয়াটি কয়েক ঘণ্টা অবধি স্থায়ী হতে পারব। তবে, দুঃখের বিষয় হলো, এই যৌনমিলনের দুই মাস পরেই মৃত ঘটে পুরুষ অক্টোপাসটির। মৃত্যুবরণ করে স্ত্রী অক্টোপাসটিও অবশ্য, কিন্ত তা ডিম ফুটার কিছুদিন পর। আর ডিমে তা দিতে স্ত্রী অক্টোপাসের সময় লাগে প্রায় ৮-১০ মাস। তবে, প্রজাতি ও তাপমাত্রার ভিন্নতার জন্য সময়ের কিছুটা আগ পিছ হতে পারে। ডিমে তা দেওয়ার সময়টাতে স্ত্রী বা মা অক্টোপাসটি খাওয়া দাওয়া অবধি ছেড়ে দেয় তার ডিম রক্ষা করতে।

•রং প্রদর্শনীতে পেশির ব্যবহারঃ  অক্টোপাসের প্রত্যেকটা ক্রোমাটোফোর কোষের ভেতর রঞ্জকসহ একটি নরম থলে থাকে, যাকে বলা হয় সাইটোউলাস্টিল স্যাক্কুলাস। এই রঞ্জক থলের চারপাশে থাকা পেশিগুলোতে টান পড়লে থলেগুলোতে প্রচণ্ড চাপ প্রবাহিত হয়। এইজন্যই অক্টোপাস আরও বেশ রঙ প্রদর্শন করে। এছাড়াও যদি পেশির টান কমে থলগুলো চুপসে পূর্বের অবস্থানে আসে, তখন আবার রঙ প্রদর্শন কমে।

•পৃথিবীর সবচেয়ে বিষাক্ত অক্টোপাসঃ অক্টোপাস শিকার ধরতে শিকারের ওপর এক ধরনের বিষাক্ত লালা ঢেলে প্রাণিটাকে অবশ করে মেরে ফেলে। সব ধরনের অক্টোপাসের মধ্যেই বিষ রয়েছে, তবে তা মানুষের জন্য ক্ষতিকর না। কেবলমাত্র ব্লু-রিংড অক্টোপাসের বিষ মানুষের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর৷ যদি এই ব্লু-রিংড অক্টোপাস কোনো প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকে কামড়ায় তবে মানুষটি কয়েক ঘণ্টাতেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে। এই অক্টোপাস কামড় দিলে বোঝা যায় না। তবে বিষ ক্রিয়া শুরু হলে নিদারুণ যন্ত্রণা হয়, যাকে কামড়ায় তার শরীরে। এই অক্টোপাসক এতোটাই বিষাক্ত যে বিষাক্ত সামুদ্রিক প্রাণিদের তালিকায় ওপরের দিকে রাখা হয়।

•পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অক্টোপাসঃ জায়ান্ট প্যাসিফিক অক্টোপাস পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো প্রজাতির অক্টোপাস। একটা জায়ান্ট অক্টোপাসের ওজন প্রায় ১৫ কেজির মতো এবং এদের বাহু সর্বোচ্চ ১৪ ফুট অবধি বিস্তৃত করা যায়। আর এই পর্যন্ত পৃথিবীতে সবচেয়ে বড়ো যে জায়ান্ট অক্টোপাস পাওয়া গেছে, এর ওজন ছিল ৭১ কেজির কাছাকাছি।

•পুনরুৎপাদন ক্ষমতাঃ মানুষের মতো অক্টোপাসের শরীরে কোনো হাঁড় থাকে না। আর এইজন্য অক্টোপাসের বাহুগুলো আঘাতে তাদের শরীর হতে আলাদা হয়ে যেতে পারে। তবে এটা নিয়ে অক্টোপাসের ভাবনার কারণ নেই। কেননা, অক্টোপাসের রয়েছে পুনরুৎপাদন ক্ষমতা। তাদের এই পুনরুৎপাদন ক্ষমতার প্রভাবে, যদি তাদের কোনো বাহু বা বাহুর অংশ কোনো ভাবে ক্ষতিগ্রস্তও হয়, তা তারা খুব তাড়াতাড়ি পুনরুৎপাদন করতে পারে।অবশ্য এই বিষয়ে নিডারিয়া পর্বের হাইড্রার সাথে অক্টোপাসের অনেকটা মিল আছে।

সমুদ্রের তলদেশের প্রাচীন এই অক্টোপাস নিয়ে বিজ্ঞানীরা যতই গবেষণা করছেন ততই যেন অবাক হচ্ছেন। কেবল মাত্র বুদ্ধি বা আচার আচরণই নয়, এই অক্টোপাসের মিস্তিষ্ক ও জিন দিনে পরীক্কগা করে আরও বিস্ময়ের সৃষ্টি হয়েছে। অক্টোপাসের জিনের সংখ্যা মানুষের চেয়ে ১০ হাজার বেশি। জিনের এই বাহারি বৈচিত্র্য নিয়ে হাজার হাজার বছর ধরে সমুদ্রের তলদেশে নিশ্চিন্তে বসবাস করছে এই রহস্যময় প্রাণি অক্টোপাস। হয়তো ভবিষ্যতে মোড়ক উন্মোচন ঘটবে আরও নতুন নতুন রহস্যের।

Back to top button

Opps, You are using ads blocker!

প্রিয় পাঠক, আপনি অ্যাড ব্লকার ব্যবহার করছেন, যার ফলে আমরা রেভেনিউ হারাচ্ছি, দয়া করে অ্যাড ব্লকারটি বন্ধ করুন।