নীতিবিদ্যার এঁফোড়-ওফোঁড়
মানুষ বুদ্ধিসম্পন্ন সামাজিক জীব। ব্যক্তি জীবনে বুদ্ধি চর্চার মাধ্যমেই সে তার সকল সমস্যার সমাধান করে এবং সমাজে টিকে থাকে। আবার সঙ্ঘবদ্ধ বসবাসের মাধ্যমে বিভিন্ন নিয়ম-নীতি, আচার- অনুষ্ঠান মেনে চলে। মানুষ তার বুদ্ধিমত্তার অনুশীলনের মাধ্যমেই সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে জীবন যাপন করে। এরমধ্যে সংযুক্ত হয় বিভিন্ন মানবিক গুণাবলী, বন্ধুত্ব, সহমর্মিতা, বিভিন্ন সামাজিক আদর্শ , বদাণ্যতা, কামনা, বাসনা, শুভ ও অশুভের ধারণা।
নীতিবিদ্যার ইতিহাস
এই হিতাহিত জ্ঞান বা শুভ-অশুভের ধারণাই মূলত মানুষের নৈতিকতা বা নীতিবোধ।
নীতিবিদ্যা ইংরেজি Ethics শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ। ইংরেজি ‘এথিংকস’ গ্রীক ‘এথিকা'( Ethica) শব্দ থেকে উদ্ভূত। যার বাংলা অর্থ আচার-ব্যবহার বা রীতি-নীতি।সুতরাং, Ethics বা নীতিবিদ্যা বলতে মানুষের আচার-ব্যবহার, রীতিনীতি বা অভ্যাস সম্পর্কীয় বিজ্ঞানকেই বোঝায়।
নৈতিকতার বিবর্তন প্রাচীন সামাজিক স্তর থেকেই দেখা যায়। প্রাচীন সমাজের প্রথা বা রীতি-নীতির স্তর থেকেই আমাদের নৈতিক ধ্যান-ধারণার সূচনা হয়। নৈতিকতার বিবর্তনের ধারা কে তাই নিম্নোক্তভাগে ভাগ করা যায়।গ্রীক নীতিবিদ্যা,মধ্যযুগীয় নীতিবিদ্যা,আধুনিক নীতিবিদ্যা ও সমকালীন নীতিবিদ্যা।
গ্রীক নীতিবিদ্যার শুরু
খ্রীস্টপূর্ব ৫০০ থেকে ৩০০ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত গ্রীক নীতিবিদ্যার আলোচনার সময়কাল ছিল বলে ধরে নেওয়া হয়। এসময়কে প্রথার স্তর থেকে বিবেকের স্তরে নীতির উন্নীত হওয়ার সময় বলে ধরে নেওয়া হয়।বিবেকের স্তরে নীতির আরোহন ঘটলেই মানুষ ন্যায়-অন্যায় ও ভালো -মন্দের বিচার করতে শেখে। বুঝতে পারে আদর্শ এবং যুক্তিতর্ক।
সোফিস্ট নীতি
হিরাক্লিটাস, ডেমোক্রিটাস প্রমুখ চিন্তাবিদদের থেকেই গ্রীক নীতির সূচনা হয়।এরপরেও সোফিস্ট , সক্রেটিস, প্লেটো ও এরিস্টটলসহ প্রমুখ চিন্তাবিদদের আলোচনাতেও নীতিবিদ্যার সম্যক ধারণা ফুটে উঠেছিল।
“মানুষ সবকিছুর পরিমাপক” এটিই ছিল সোফিস্ট মূলনীতি।
তবে সোফিস্টিদের চিন্তাভাবনার চাইতেও সক্রেটিস চিন্তাধারা একসময় বেশি গুরুত্ব পায়।তিনি বলেন, “জ্ঞ্যানই পূন্য”। তাঁর মতে, “ন্যায় সম্পর্কে প্রকৃত জ্ঞ্যান ছাড়া ব্যক্তির পক্ষে ন্যায় কাজ করা সম্ভব না”।
মধ্যযুগীয় নীতিবিদ্যার শুরু
এদিকে মধ্যযুগীয় নীতিবিদ্যার আলোচনার পরিসর ছিল ৪০০ খ্রীস্টাব্দ থেকে চতুর্দশ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত। মধ্যযুগীয় নীতিবিদ্যায় গির্জার বেশ প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।সেসময় খ্রিস্টান ধর্মের প্রাধান্য এত বেশি ছিল যে ধর্মীয় যাজকদের নির্দেশেই সবকিছু নির্ধারিত হত।মধ্যযুগীয় চিন্তাবিদদের মধ্যে সেন্ট অগাস্টিন,সেন্ট এনসেলম,থমাস একুইনাস প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। মধ্যযুগীয় চিন্তাধারার স্থায়িত্বকাল বেশিদিন ছিল না।পঞ্চদশ ও ষোড়শ খ্রীস্টাব্দে বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার সাথে সাথে এবং রেনেসা আন্দোলনের মুখে মধ্যযুগীয় নীতিবিদ্যার পতন ঘটে।
সপ্তদশ শতাব্দীতে রেনেসা আন্দোলনের ফলশ্রতি হিসেবে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদের এক বিরাট ঢেউ আসে,ব্যক্তির চিন্তা ও কর্মে তখন এক অভূতপূর্ব আলোড়নের মধ্যে দিয়েই আধুনিক নীতিবিদ্যার সূচনা হয়।
হবসের নীতি
আধুনিক নীতিবিদ্যার ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম থমাস হবস (১৫৮৮-১৬৭৯) এর চিন্তাধারা পরিলক্ষিত হয়।হবসের মতে,”নৈতিক আদর্শ ঐশী ইচ্ছা বা প্রকৃতি দ্বারা নিরূপিত হয় না।বরং ব্যাক্তি নিজেই তার নৈতিক জ্ঞ্যানের সাহায্যে আচরণের ভালো ও মন্দ নির্ণয় করে।”
তিনি মনে করেন,”আত্নপ্রীতিই মানব প্রকৃতির প্রধান বৈশিষ্ট্য।”
বুদ্ধিমূলক সংজ্ঞাবাদ
হবসের নীতিকে পরবর্তীতে হেনরী মোর (১৬১৪-১৬৮৭) এবং কাডওয়ার্থ(১৬১৭-১৬৮৮) নতুন করে বিন্যাস করেন। তাঁরা মনে করেন,”নৈতিক নিয়ম গানিতিক নিয়মের মতো স্বত: সিদ্ধ ও অপরিবর্তনীয়।”
কাডওয়ার্থ, ক্লার্ক ও মোরের নৈতিক মতবাদ বুদ্ধিমূলক সংজ্ঞাবাদ (Radiational Institutionism) নামে পরিচিত।
স্পিনোজা মতবাদ
পরবর্তীতে স্পিনোজা (১৬৩২-১৬৭৭) আধুনিক নীতিবিদ্যায় আধিবিদ্যক চিন্তাধারা প্রবর্তনের মাধ্যমে অবদান রাখেন।তিনি মনে করেন,”আধিবিদ্যক সূত্র থেকেই নৈতিক নিয়ম অনুসৃত।”
স্পিনোজা এর পরে উনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত অনেকের চিন্তাধারাই পরিলক্ষিত হয়। তারা আধুনিক নীতিবিদ্যাকে সমৃদ্ধ করতেও বেশ অবদান রাখেন।
আধুনিক নীতিবিদ্যা
আধুনিক নীতিবিদ্যায় আদর্শনিষ্ঠ কোন মান নিরূপণে নীতিবিদগণ একমত হতে পারেন নি।তাই সেসময় তারা ছিলেন দ্বিধাবিভক্ত।ঠিক তখনি বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ব্রিটিশ দার্শনিক ম্যূরের আবির্ভাব ঘটে এবং তাঁর ‘প্রিন্সিপিয়া এথিকা’ (১৯০৩) গ্রন্থ সমকালীন নৈতিক দর্শনের রূপরেখা প্রণয়নের ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সংযোজন ঘটায়।ম্যূরের মতে,”নৈতিক ধারণা বা পদের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ ;এবং নৈতিক অবধারণ ও সিদ্ধান্তে নিহিত যৌক্তিকতা নিরূপণের পরেই নৈতিক আদর্শ বা মান নির্ণয় করা সম্ভব।”
নীতিবিদ্যার ধারণা ও প্রসার পরবর্তীতে আরও বেগবান হয়। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দার্শনিক নীতিবিদ্যা সম্পর্কিত তাদের মতামত স্পষ্ট করে তুলে ধরেন।
গ্রীক নীতিবিদ্যার ধারণা থেকে আজকের বর্তমান সময়ে নীতিবিদ্যাতে বেশ পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংযোজন -বিয়োজন এসেছে।তবে একথা বলতেই হয়, সভ্যতার শুভলগ্ন থেকেই মানব সমাজে নৈতিকতার বহু শাশ্বত বাণী প্রচলিত। যুগের পর যুগ যা মানবসমাজ অনুসরণ করে আসছে। ধারণ করছে নিজের ভেতরেই।
সৃষ্টির আদি থেকে সেসব প্রচলিত বানী যেমন: সদা সত্য কথা বলবে, দুঃখীজনকে দয়া করো ও পাপীকে ঘৃণা করো, ন্যায়ের সমর্থন করো ও অন্যায়কে প্রতিহত কর ইত্যাদি আজও প্রচলিত আছে।
নীতিবিদ্যা ভালো -মন্দের তফাত ঘটিয়ে আমাদের অন্তরআত্নাকে কলুষিত মুক্ত রাখে।আমাদের সমাজ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে শুভ নৈতিকতার মূল ধারার প্রচলন সর্বদা কাম্য।
জান্নাতুল ফেরদৌস, শিক্ষার্থী ও সমাজকর্মী