ফিচারশিল্প ও সাহিত্য

পৃথিবী থেকে ডাইনোস,র কীভাবে বিলুপ্ত হয়েছিল?

পৃথিবী থেকে ডাইনোস,র কীভাবে বিলুপ্ত হয়েছিল? এই যে সবুজ শ্যামল পৃথিবী। পৃথিবীর বুক জুড়ে হাজার হাজার প্রাণির বসবাস। আর তার মধ্যে বর্তমানে পৃথিবীকে রাজত্ব করছে মানুষ। কিন্তু, কয়েকশ কোটি বছর আগে এই পৃথিবীটা ছিল ডাইনোসরদের। তারাই করতো রাজত্ব। ডাইনোসর শব্দটি শুনলেই চোখে ভেসে ওঠে প্রকাণ্ড দেহধারী, লেজবিশিষ্ট এক প্রাণির ছবি। হ্যাঁ, সেই প্রকাণ্ড প্রাণিরাই রাজত্ব করতো এই পৃথিবীটাকে। কিন্তু সেই ডাইনোসরা এখন নেই কেন? কোথায় হারিয়ে গেল? প্রিয় পাঠক, আজকে আমাদের এই আর্টিকেলে জানব—পৃথিবী থেকে ডাইনোসর কীভাবে বিলুপ্ত হয়েছিল? এই গল্প!

ডাইনোসরদের জন্ম ঠিক কত আগে ঘটেছিল, তা নিয়ে এখনো গবেষণা চলমান। তবে ধারণা কর হয়, ট্রায়াসিক যুগের শেষ পর্যায়ে অর্থাৎ ২৩১-২৪০ মিলিয়ন বছর পূর্বে কোনো এক সময় বিবর্তনের মধ্যে এই ডাইনোসরদের জন্ম হুয় এবং পৃথিবী জুড়ে এরা রাজত্ব করেছে জুরাসিক যুগে। আর পৃথিবী হতে এদের বিদায়টা ঘটে প্রায় ৬৬ মিলিয়ন বছর পূর্বে ক্রিটেশাস-প্যালিওজিনের বিলুপ্তির ঘটনাতে। আর সবচেয়ে বড়ো এই প্রাণি, গণ ও প্রজাতি ভিত্তিক ৭০-৮০ ফুট দীর্ঘ, ওজন হতে পারতো ১০০ টন অবধি। সেই বিশাল আকৃতির প্রাণির বিলুপ্তির কারণ নিয়ে বর্তমানে পৃথিবী রাজত্ব করা মানুষের আগ্রহ যেন খুব বেশিই। বিভিন্ন গবেষণার ভিত্তিতে প্রায় সকল বিজ্ঞানীই একমত যে, পৃথিবীতে আজ অবধি প্রায় পাঁচটি মহাবিলুপ্তি ঘটেছে। আর এই মহাবিলুপ্তি ঘটার কারণটা হয়তো কোনো কারণে জলবায়ুর হঠাৎ বদল হয় এবং যা প্রাণধারণের জন্য অনুপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। এই মহাবিলুপ্তি ঘটার প্রতিবারই পৃথিবীর সকল উদ্ভিদ ও প্রাণিদের অধিকাংশ প্রজাতিই বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। আর অল্প যে প্রজাতিগুলো বেঁচে গিয়েচগিলো, তা থেকেই অভিযোজনের মাধ্যমে বির্বতন ঘটে নতুন নতুন প্রজাতির৷

তবে ধারণা করা হয়, এখন অবধি সর্বশেষ মহাবিলুপ্তি হলো ক্রিটেশাস-প্যালিওজিন বিলুপ্তি। আর এতেই বিদায় ঘটেছে দৈত্যাকার ডাইনোসরদের। এই বিলুপ্তিকে কে-পিজি বা কে-টি বিলুপ্তিও বলা হয়। গবেষকেরা এই কে-পিজি বা কে-টি বিলুপ্তির জন্য দায়ী করেন আগ্নেয়গিরিকে। আর তাদের মতে, এই আগ্নেয়গিরির লাভা গ্রীন হাউস গ্যাস কার্বন ডাই-অক্সাইড, ছাই এবং সালফার কণা বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে তা কুয়াশার মতো আকার ধারণ করে। ফলে সূর্যের আলো পৃথিবীতে ঢুকতে পারছিল না আর তখনই শুরু হয় মহাবিলুপ্তি। পানিতে থাকা ক্ষুদ্র প্ল্যাংকটন হতে বিশাল গাছ কেউই সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া ঘটাতে ব্যর্থ হয় এবং মরে যায়। আর উৎপাদক পর্যায়ের খাদ্য বন্ধ হওয়ায় প্রাথমিক, সেকেন্ডারি পর্যায়ের প্রাণিদেরও আস্তে আস্তে মৃত্যু ঘটে।

এই কে-টি বিলুপ্তির কারণ হিসাবে আরেকটি চমকপ্রদ ব্যাখ্যা রয়েছে। এই ব্যাখানুসারে, পৃথিবীর সাথে কোনো এক গ্রহাণুর সংঘর্ষের ফলেই ঘটেছে এমন বিলুপ্তি। আর বিশাল আকারের গ্রহাণু প্রচণ্ড গতিতে পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠে আঘাত হানলে সুনামি এবং ভূমিকম্পের তৈরি হয় এবং বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে নানা ধূলিকণা, ধাতব কণা। এরপরে আগ্নেয়গিরি ঘটনার মতোই হুবাহু ঘটার কথা। তবে, এই গ্রাহাণু আঘাতের তত্ত্ব প্রথমদিকে বিজ্ঞানীরা মেনে না নিলেও ১৯৮০ সালে বেশ বড়ো প্রমাণ মিলে এর স্বপক্ষে। তখন নোবেলবিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী লুইস আলভারেজ এবং তার ছেলে ওয়াল্টার মাটিতে খুঁজে পায় অবস্থান্তর ধাতু ইরিডিয়ামের তৈরি আস্তরণ, যা প্রায় ৪৬ মিলিয়ন বছর পুরানো। আর এই ভঙ্গুর অবস্থান্তর ইরিডিয়ামের খোঁজ মেলে পৃথিবীর আরও শতাধিক জায়গায়। আর এই ধাতুটি সোনার চেয়েও দুর্লভ।

এখন প্রশ্ন হলো, তবে এই ধাতুর আস্তরণ কেমন করে তৈরি হলো?

প্রিয় পাঠক, হয়তো পৃথিবীতে এই ইরিডিয়াম দূর্লভ, কিন্তু মহাবিশ্বে এই ধাতু তো দূর্লভ নয়। তাই আরও শক্তভাবে বলা যায়, ওপরের তত্ত্বের গ্রহাণুতেই ছিল এই ধাতু, যা পৃথিবীর সাথে সংঘর্ষের পর পৃথিবীর বাতাসেও ছড়িয়ে পড়ে। এরপর যখন পৃথিবী শান্ত হয়, তখন তা মাটিতে জমাট বাঁধে আর তৈরি করে এমন আস্তরণের। আর এই আস্তরণে কেবলমাত্র যে ইরিডিয়াম পাওয়া গিয়েছে তা কিন্তু নয়, এছাড়াও পাওয়া গিয়েছে শকড কোয়ার্টজ, কাঁচের গুড়ো। ধারণা করা হয়, যখন গলিত পাথর বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়ে এবং পড়ে যখন ঠাণ্ডা হয়ে জমা হয়, তখনই এই কাঁচের গুড়ার তৈরি ঘটে। আর এমন বড়ো রকমের যে দাবানল ঘটেছে, তার প্রমাণ হিসাবে পাওয়া গিয়েছে প্রচুর ছাই ও ঝুল। আর এই গ্রহাণুর সংঘর্ঘের নমুনাগুলো বেশি দেখা যায় উত্তর আমেরিকাতে। মেক্সিকোর উপসাগরে সুনামির কবলে ছড়ানো পাথর, নানা দুলর্ভ ধাতুর অস্তিত্ব এবং হাইতির কাদামাটিতে কাঁচের গুড়োর ইঙ্গিতেই বোঝা যায় গ্রহাণু আছড়ে পড়েছিল।

আমরা টেলিস্কোপ দিয়ে চাঁদের দিকে তাকালে যে বিশাল বিশাল ক্র্যাটার বা গর্ত দেখতে পাই তা পৃথিবীতে তেমন দেখা যায় না। তাই এসব গ্রহাণুর আঘাতে তৈরি হয়েছে নাকি আগ্নেয়গিরির জন্য হয়েছে, এই নিয়ে বেশ বির্তক ছিলই। কেননা, কে-টি বিলুপ্তির মতো এতো বিশাল বিলুপ্তির জন্য প্রয়োজন ১০ কিলোমিটার ব্যাসের গ্রহাণুর। যার আঘাত এত জোরে আছড়ে পড়তে হবে যাতে করে অন্তত ১০০ কিলোমিটার ব্যাসের গর্ত তৈরি হয়। কিন্তু, আগ্নেয়গিরিগুলো তখনো জীবিত থাকায় এই আগ্নেয়গিরির তত্ত্ব আর গ্রহাণুর আঘাতের ত্তত্ব কোনটাইকেই সুনিশ্চিত কারণ হিসাবে ধরা যাচ্ছিল না। তবে, ১৯৯০ সালে বির্তকের প্রায় অবসান ঘটলো। মেক্সিকোর উপ্পকূলের কাছাকাছি সাগরতলে ভূবিজ্ঞানী অ্যালান হিল্ডেব্র্যান্ড খুঁজে পেলেন বিশাল এক ক্র্যাটার; যা প্রায় ১৮০ কিলোমিটার প্রশস্ত ছিল। এছাড়াও এই গর্তের কাছাকাছি ছিল অদ্ভুত অভিকর্ষ বল এবং সেই সাথে পাওয়া গেল আগ্নেয়শিলা, কাঁচের গুড়া, ব্রেক্কিয়া, ইত্যাদি। আর এর ইঙ্গিতটা বোঝায় গ্রহাণুর আঘাতের তত্ত্ব।

এই ক্র্যাটারের আকৃতি থেকে বোঝা যায়, পৃথিবীতে কোনাকুনিভাবে আছড়ে পড়েছিল গ্রহাণুটি, এর ফলে এটি পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠ হতে অনেকটাই পিছলে উত্তর আমেরিকার দিকে ধুলোবালি, পাথর টুকরো ছড়িয়ে দিয়েছিল। আর এত বড়ো গ্রহাণুর আঘাতে কাঁপুনিতে পাথর ভেঙে যাওয়ার কথা, গলিত পাথর বায়ুতে ছড়ানোর কথা, এছাড়াও অধিক তাপে আশেপাশের সবকিছু ধ্বংস হওয়ার কথা। বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন যে, এই বিশাল কাজটি ঘটেছে গ্রহাণুর সংঘর্ষেই। আর তখনকার আঘাতের ভূমিকম্পের প্রায় ১১ মাত্রা ছিল। তাই আশেপাশের সবকিছুই ছিটকে পড়বে, যাতে অনেক কিছু বায়ুমন্ডল ভেদ করে বাইরেও যাবে, আবার যা ফিরবে তা জ্বলন্ত অবস্থায়। হয়তো অগ্নিবৃষ্টির কবলে পড়বে এলাকাটি এবং আশেপাশে অগ্নিকাণ্ড হয়ে সব জীব মারা যাবে। এসবই সময়ের ব্যাপার মাত্র।

এছাড়াও খুঁজে পাওয়া ক্র্যাটারের আকৃতি নিয়ে গবেষণা করে বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন— যখন গ্র্হাণু আঘাত হানে পৃথিবীতে সেই সময় আশে পাশের সবকিছু তরলের ন্যায় আচরণ করেছিল এবং সেই সাথে গলিত পাথর, সালফার, ছাই বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়েছিল। ফলে পৃথিবী কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল। যার সময়সীমা কয়েক সপ্তাহ থেকে কয়েক মাস ছিল। আর এতেই ঘটে প্রাণি ও উদ্ভিদের বিদায়। কারণ তখন সূর্যের আলো পৃথিবীতে না আসতে পারায় বরফখণ্ডের ন্যায় অবস্থা হয়েছিল পৃথিবীর। এর আগেই উদ্ভিদের সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া বন্ধ হওয়ায় উদ্ভিদ মারা যায়, এরপরে খাদ্যশৃঙ্খলে ধস নামে এবং পুরো জীবকুলই একসময় হারিয়ে যায়। তবে কিছু ইঁদুরের মতো প্রজাতি বেঁচে ছিল। যা থেকে আজকের মানুষের উৎপত্তি। যদিও এ নিয়েও চলছে তর্ক বিতর্ক।

আরো পড়ুন: যেকোনো বিরিয়ানি রান্নার সহজ পদ্ধতি

যাই হোক, ডাইনোসরদের বিলুপ্তির ঘটনা এখানে শেষ নয়। গ্রহাণু যেখানে আঘাত হানছিল, তার প্রায় তিন কিলোমিটার জুড়ে পুরু কার্বনেট পাথরের স্তর ছিল। ফলে বায়ুমন্ডল কিছুটা পরিষ্কার হপ্লে তখন আবার শত শত কোটি টন কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যায় এবং সৃষ্টি হয় এসিড বৃষ্টির। ধারনা করা হয়, তখনকার পৃথিবীর, ৭০% প্রাণি মারা যায় এর কারণে। আর এর মধ্যে ছিলো ডাইনোসরদের প্রায় অধিকাংশ প্রজাতি। সবার প্রথমে মারা পড়েছিল এই বিশাল আকৃতির ডাইনোসররা।

এই গ্রহাণু আঘাতের বিশেষ প্রমাণ পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা মেক্সিকোর ইউকাতান চিকশুলুব অঞ্চলে। এই আঘাতকে বিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন চিকশুলুব সংঘর্ষ। শহরের কাছে পাওয়া ১৮০ কিলোমিটার ব্যাস আর ২০ কিলোমিটার গভীরতার ক্র্যাটারটির বয়স বিজ্ঞানীরা হিসাবনিকাশ করে বের করেছেন, যা ৬৬ মিলিয়ন বছরের থেকে অল্প কম। আর এটা কেপিজি বা কে-টি বিলুপ্তির তত্ত্বের সাথে হুবাহু মিলে যায়। তবে এখনো অনেকেই বিশ্বাস করেন, এই গ্রহাণুর আঘাতেই বিলুপ্তি ঘটে নি ডাইনোসরদের। এরা ধীরে ধীরে বিদায় নিয়েছে পৃথিবী হতে। আর এই মহাবিলুপ্তির প্রায় ৩ লাখ বছর পূর্বে চিকশুলুব সংঘর্ষ হয়েছিল। আবার এমন ও হবার সম্ভাবনা থেকে যায় গ্রহাণুর আঘাতে সকল ফসিল ওপরের ওঠে এসেছিল। তবে গ্রহাণু যে আঘাত হেনেছে এটা নিশ্চিত, কিন্তু এই গ্রহাণুর আঘাতেই যে ডাইনোসরদের বিদায় ঘণ্টা বেজেছে তা খুব একটা প্রমাণিত না।
তবে, এখন পর্যন্ত ডাইনোসরদের বিলুপ্তি ঘটার যতগুলো তত্ত্ব রয়েছে, এর মধ্যে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ব্যাখ্যা বা তত্ত্ব। হয়তো ভবিষ্যতে নিশ্চিত কারণ জানা যাবে, আবার যাবে না।

কিন্তু পৃথিবীতে রাজত্ব করা সব ডাইনোসরের যে বিলুপ্ত ঘটেছিল এমন নয়। কেবলমাত্র ডিপ্লোডকাস, ব্রাকিওসরাসের মতো দৈত্যাকার ডাইনোসররা বিদায় নিয়েছিল। তবে এই যে বর্তমানে পাখি দেখেন, এরা আদতে ডাইনোসরদের বংশধরই। অর্থাৎ, নন-এভিয়ান ডাইনোসরা বিলুপ্ত হলেও এভিয়ান ডাইনোসরা টিকে ছিল। আর তারাই এখন আমাদের চারপাশে প্রতিনিয়ত উড়ে বেড়াচ্ছে।

Back to top button

Opps, You are using ads blocker!

প্রিয় পাঠক, আপনি অ্যাড ব্লকার ব্যবহার করছেন, যার ফলে আমরা রেভেনিউ হারাচ্ছি, দয়া করে অ্যাড ব্লকারটি বন্ধ করুন।